USProxyWar Myanmar
ক্লাউড টিভি ডেস্ক: মায়ানমারে গৃহযুদ্ধের দীর্ঘদিনের জটিল পরিস্থিতি ও দেশটির সাম্প্রতিক সামরিক সরকারের প্রভাব সেদেশের স্থিতিশীলতার স্বপ্নকে চূর্ণ করে দিয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব কমানোর উদ্দেশ্যে মায়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ (USProxyWar Myanmar) শুরু করার পরিকল্পনা করছে। এই পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তা শুধু মায়ানমারের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে না; বরং এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
২০১৭ সালে ভারতের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে চীন এবং মায়ানমার এক ঐতিহাসিক চীন-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (China-Myanmar Economic Corridor, CMEC) চুক্তিতে সম্মত হয়। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর অংশ হিসেবে মায়ানমারের কিয়াকপিউ (Kyaukpyu) বন্দর পর্যন্ত রেল, সড়ক ও পাইপলাইন নির্মাণ করা। এই বন্দরটি ভারত মহাসাগরে চীনের সরাসরি প্রবেশের পথ খুলে দেবে।দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ানের উত্তেজনার মাঝে পড়লে বেইজিং তাদের ইকোনমিক ‘আউটলেট’ হিসেবে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঢোকা নিশ্চিত করতে চায়। এই লক্ষ্যে মায়ানমারকে ব্যবহার করে চীন সৌন্দর্যবতী বন্দর-রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।
একদিকে মায়ানমার তার বন্দর, অবকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক সুবিধা পাবে; অন্যদিকে চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত ভাবে প্রবেশাধিকার পাবে। এতে ভারতের নিরাপত্তায় পরিবর্তন আসতে পারে, কারণ চীন যদি সৈন্য-নৌবাহিনী বা সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কিয়াকপিউ (Kyaukpyu) বন্দর ব্যবহার করে, তবে ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনী সরাসরি হুমকির মুখে পড়বে ।
মায়ানমার উত্তর-পূর্ব ভারতের সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, অস্বিগড়া (Assam-যোগাযোগ) সহ একাধিক রাজ্যের সঙ্গে সীমান্ত শেয়ার করে। প্রায় ২৭০০ কিমি লম্বা এই সীমান্ত ভারতের জন্য নীতিগত ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মায়ানমারে অস্থিরতা বাড়লে এই সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ অস্ত্র, সন্ত্রাসী সংগঠন বা দার্শনিক ঘাতকদল প্রবেশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সুতরাং, মায়ানমারেই না, ভারতেও এ স্থিতিশীলতার অভাব কেড়ে নেবে দেশের উত্তরের শান্তি।
‘প্রক্সি যুদ্ধ’ মূলত দুই বা ততোধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি সংঘাত না করে, গৃহযুদ্ধ বা স্থলীয় সংঘাতে তৃতীয় পক্ষের (প্রক্সি, বিশেষত বিদ্রোহী দল বা অসঙ্গঠিত গ্রুপ) মাধ্যমে আর্থিক, সামরিক বা কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে সংঘাত পরিচালনা করার কৌশলকে বোঝায়। ইতিহাসে সোভিয়েত-যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে মুসলিম মুজাহিদীনদের মাধ্যমে সোভিয়েত সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা একটি সুপরিচিত উদাহরণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগর ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক উন্নয়নের প্রতি নজর রাখছে । মায়ানমারের কিয়াকপিউ বন্দর চীনের কাছে একটি কৌশলগত সোনালী স্বর্ণখনি তৈরির মতো—এটি সামুদ্রিক পথে সরবরাহমূলক শৃঙ্খলে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এই পথ ভেঙে দিতে চায়।
অপরদিকে মায়ানমারের সামরিক শাসক এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক ফোর্স NUG, ইথনিক আর্মড গ্রুপস ও বিদ্রোহী দল এর মধ্যে আইডিওলজিকাল ডিফারেন্স ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে, তারা কিয়াকপিউ বন্দর নিয়ন্ত্রণে চীনকে বাধা দেবে।
২০২১ সালের সামরিক অভিযানের পর মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য ফাঁস হয়ে যায় । হুন্ড্রেডস বাইন্ডেড কিজন, গণহত্যা, নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন—এগুলোকে আমেরিকা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সামরিক শাসককে দুর্বল করার পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষা ও গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে সমর্থন করা নৈতিক দায়িত্বও মনে করতে পারে।
মায়ানমারের উত্তর মিয়ো আগামী সীমানায় অবস্থিত ইথনিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো (যেমন কাকি (Kachin), কারেন (Karen), নাগা) প্রথাগতভাবে কেন্দ্রীয় মায়ানমার সরকারের বিরোধী। গত কয়েক বছর ধরে তারা সামরিক সরকারের কঠোরতা নিষিদ্ধ করার জন্য লড়াই করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সামরিক সরঞ্জাম, গোয়েন্দা তথ্য, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করতে পারে, তারা সামরিক বাহিনীকে যথেষ্ট বেগ দিতে সক্ষম।
মায়ানমারের অভ্যান্তরীণ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ বহু দশক ধরে চলে আসছে। সামরিক বাহিনী (Tatmadaw)-এর বিরুদ্ধে এথনিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন আরমি’ (National Unity Army, NUG) ও ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকার’ (NUG) গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা শক্তি তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্তরে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করবে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মায়ানমারের সামরিক শাসনকারী বগন সিন ডি লেট ক্ষমতা দখল করে, নির্বাচন বাতিল করে এবং অং সান সু চি সহ সাধারণ নির্বাচনে জয়ী নেতাদের কারাগারে বন্দি করে। এ ঘটনাকে ‘গ্লোরিফাইড ভয়েজুয়্যার’ বলে উল্লেখ করা যায়, কারণ সামরিক বাহিনী স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক চাহিদাকে বরখাস্ত করে এ অভ্যুত্থান ঘটায়। এর পর থেকে দেশজুড়ে গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং রক্তাক্ত দমন-পীড়ন শুরু হয়।
এদিকে সামরিক বাহিনীর বিপরীতে সংগঠিত হয় গোপনীয় ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’ (People’s Defence Forces, PDF)। তারা স্থানীয় স্তরে গুপ্তচর, সামরিক অভিযান ও স্বল্পসামরিক স্পন্দনমূলক লড়াই চালায়। সরাসরি সীমান্তবর্তী এলাকা—কাশিন, কারেন, নগা, চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী অঞ্চল—এখানে বহু ইথনিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে স্বশাসন দাবি করে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (KNU), কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন আর্মি (KNLA), কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (KIA) এবং নাগাল্যান্ড-এর পথ নাইন্যাত (NSCN) অন্যতম। তারা সামরিক সমর্থন পেলে আরও শক্তিশালী লড়াই চালাতে পারবে।
মায়ানমার-ভারত সীমান্ত প্রায় ১,640 কিমি দীর্ঘ, যার মধ্যে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, আসাম, মিজোরাম, কচিয়াপুরে বিভিন্ন সীমান্ত পিওসি (POC) রয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর কিছু এথনিক বিদ্রোহী দল (যেমন ULFA, NSCN-IM, NSCN-K), দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারে লুকিয়ে থেকে নিরাপদ আশ্রয় পায়। সেখানে অনবরত অস্ত্র লাভের এই সুযোগ তাদের হাত পুনরায় শক্তিশালী করবে। এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিপুল আশঙ্কা তৈরি হবে।
গৃহযুদ্ধ, দুর্যোগ আর দারিদ্র্যের ত্রিমুখী সঙ্কটে বিপর্যস্ত মিয়ানমার
বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেলের ভারতীয় উত্তর-পূর্ব দখলের হুমকি: কূটনৈতিক উত্তেজনার নতুন মাত্রা
উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যই সীমান্তবর্তী, যেখানে চা-বাগান, কৃষি নির্ভর অর্থনীতি, ক্ষুদ্রশিল্প ও হস্তশিল্পের উপর নির্ভরশীল । মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের বাড়বাড়ন্ত এখানে অবৈধ পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, মাদক পাচার সহজ করছে, ফলে:
মাদক সমস্যা: মায়ানমারের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ এলাকা থেকে সস্তা ও ভেজা মাদক ভারতে ঢুকে পড়ছে। এতে উত্তর-পূর্বের তরুণ প্রজন্ম বিপদে পড়ছে।
বানিজ্য ও বাণিজ্য: সীমান্ত বিপণনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, কারণ শুল্ক চেকপোস্ট বন্ধ, আয়কর বিপণন বন্ধ এবং শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।
পর্যটন খাত: পাহাড়ি স্বাদ, পর্যটক আকর্ষণীয় স্থান (যেমন দার্জিলিং, মেঘালয়, মণিপুরের লেইচেরা), শরণার্থীর সঙ্কটের কারণে বুকহাটা পর্যটক সংখ্যা কমে যাবে, যা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ।
ভারত সবসময়ই ‘নন-অ্যালাইনমেন্ট ভুমিকা’ পালন করে আসছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ‘ইন্ডো-প্যাসিফিক’ ভূরাজনৈতিক বিন্যাসে সুরক্ষার কারণে শক্তি সমন্বয় (যেমন “Quad” = আমেরিকা, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) করছে। মায়ানমারের ক্ষেত্রে:
মিশ্র ভূমিকা: ভারত মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানকে কখনো মঞ্জুরি করেনি, আবার নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
উত্তর-পূর্বের শান্তি: ভারত চাইবে, মায়ানমার শান্তিশীল হোক; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে সামরিক সামর্থ্য বাড়ায়, তবে ভারতকে সীমান্ত নিরাপত্তায় অতিরিক্ত ব্যয় ও পরিকল্পনা করতে হবে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান আক্রমণ করলে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়। এই সহায়তা পরবর্তীতে ৯১১ হামলার মূল ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। মুজাহিদিনরা পরবর্তী আল কায়েদা, তালেবান, বোকো হারাম ইত্যাদি গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়।
ভারতের সাবধানতা: ভারত তখন সোভিয়েত-বিরোধী মুজাহিদীদের সরাসরি সমর্থন করেনি। কারণ জানত, আফগানিস্তান বিনষ্ট যাওয়ার পর এটি সম্প্রসারিত হয়ে ভাবনা ও সন্ত্রাসী আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। এতো বছর পরও সেই ভুলের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় অনুভূত হচ্ছে।
শরণার্থী ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। সেগুলো সম্প্রসারিত না করে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সরবরাহ চালু রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা: UNHCR, IOM ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা সঙ্গে সমন্বয় করে শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসা সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
মায়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান, চীনের প্রতি দেশটির নির্ভরতা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতের চেয়ে বহু জটিল হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের শীতল যুদ্ধকালীন অনভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, “একজন বিদেশী শক্তি অন্যদেশে অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীকে সহায়তা করলে তা পরবর্তীতে নিজ দেশেও বিপদ উত্থাপন করে।”
উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা যদি অটুট থাকতে হয়, তাহলে ভারতকে সীমান্ত রক্ষায় জোর দিতে হবে, মায়ানমারের ওপর কূটনৈতিক ও মানবিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিজের অবস্থান মজবুত করতে হবে। তবেই এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন :
দীপিকা কাক্কার আক্রান্ত লিভার ক্যান্সারে, স্টেজ ২-এ ধরা পড়ল টিউমার
দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে কানাডার মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে, ম্যানিটোবায় জরুরি অবস্থা