IPL2025 Business
শান্তিপ্রিয় রায়চৌধুরী : এখন আছে, আগেও ছিল, হালে বাজারে একটা কথা খুব চলছে- যারা ক্রিকেটের কিছু বোঝেন না তারাও আইপিএল বোঝেন (IPL2025 Business)। তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়ালো আইপিএল কোন ক্রিকেটই না! আইপিএল জমজমাট বাণিজ্যের খেলা, টাকার খেলা যেখানে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। অর্থের ডামাডোলের মাঝে এমনটি আপনার মনে হতেই পারে, কিন্তু একটু ভাবলে দেখবেন এর চেয়ে উত্তেজক চুম্বক প্রবণ মুহূর্ত আর কিছুতেই নেই। এমনকি শাহরুখের সিনেমা কিংবা স্টার চ্যানেলে পরকিয়ায় ভরা হিন্দি সিরিয়াল গুলোতেও নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে কলকাতা মুম্বাই পর্যন্ত মার্কেট, অফিস, বাথরুমে আনন্দে বেদনায় সবাই শুধু আইপিএল নিয়েই ভাবে। কেন এমন হলো, সবাই কি তবে ক্রিকেট বুঝে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেল?
সবাই ভেবেছে, কারণ সবাইকে ভাবানো হয়েছে। বাজার- বাণিজ্য আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে। সবার সামনে গোটা ব্যাপারটা এমন ভাবে রান্না করে পরিবেশন করা হয়েছে যে লোভ না হয়ে উপায় নেই। বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাজার সব সময়ই মানুষকে লোভ দেখায়। সেই লোভে সামিল হওয়া মাত্রই আমরা ভারতীয়রা মূল স্রোতে হারিয়ে যাই। সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেই আপনাকে ‘গেঁয়ো,আন কালচারড,’ বলা হবে। আপনি যদি এই ধরনের ক্রিকেটকে (IPL2025 Business) পাত্তা না দেন, বলেন, ধুত্তরি এর কোন মানে হয়, দেখবেন বাজার আপনাকে পাত্তা দেবে না। আর আইপিএল ও আপনাকে একলা ফেলে রেখে মূল স্রোতে নিয়ে উৎসবে লেগে পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আইপিএল মানুষ খাচ্ছে তাই এটা থাকবে, আপনার না পোষালে আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে!
অর্থনীতির কাছে এই যে গোহারা এটা নতুন কিছু নয়। আগেও ছিল। ভারতে ছিল তো বটেই। হঠাৎ করে ভাবার কোন কারণ নেই যে ক্রিকেটের মধ্যে অর্থটা ঢুকে পড়া কেবল এ যুগের কান্ড। এর আগেও ঘটেছে এবং বেশ বুক চিতিয়েই ঘটেছে। গত শতকের শুরুর দিকেই ভারতীয় ক্রিকেট বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছিল। ইউরোপিয়ান, পারসি, হিন্দু, মুসলমান ও রেস্ট অফ ইন্ডিয়া – এই পাঁচজন নিয়ে সেই সময় বেশ রমরমার সাথে চলছিল প্যান্টাঙ্গুলার নামের এক টুর্নামেন্ট। দলের নামগুলো একটু মন দিয়ে খেয়াল করুন। খেলাগুলি হয়েছিল বেশ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাও আবার কোন সময় চিন্তা করুন – যখন গান্ধীজি একে একে সহযোগ অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার বিশ্ব যুদ্ধের ছায়ায় ধুকছে, বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দায় বিধ্বস্ত। তখন এমনও হয়েছে যে মুম্বাইতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেঁধেছে। তারপরেও পেন্টাঙ্গুলার নির্বিঘ্নে চলেছে। প্রতিযোগিতার কয়েকদিন পর সে দাঙ্গা থেমেও গেছে। সেটা ছিল এমন একটা প্রতিযোগিতা যেখানে হিন্দু-মুসলমান দল বানিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে, চারিদিকে তখন মার মার কাটকাট অবস্থা। অমন বিষাক্ত সময়ে পেন্টাঙ্গুলার ভেস্তে যাওয়ার কথা, কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। ১৯৩০ এর বোম্বেতে হিন্দু-মুসলমানদের জন্য আলাদা পাবলিক বাথরুম, রেল স্টেশনে জল খাওয়ার পাত্রে পর্যন্ত ভিন্ন গ্লাস। সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও পেন্টাঙ্গুলার চলাকালীন একটা সাম্প্রদায়িক ঘটনাও ঘটেনি। তা কি ক্রিকেটের প্রতি প্রেমের জন্যই হয়েছে? কিন্তু গবেষণা অন্য কথা বলে, বলে অর্থনীতির কথা, বলে বাজার বাণিজ্যের কথা। হিসাব করে দেখা গেছে, পেন্টাঙ্গুলার যে পরিমাণ ব্যবসা করেছে, তা বন্ধ হয়ে গেলে মুশকিলে পড়বে ক্লাবগুলো। ক্লাব গুলোর মানুষ, তারা হিন্দু বা মুসলমান যেই হোক সবাই চলতো পেন্টাঙ্গুলারের টাকাতেই। তাই এক্ষেত্রে টুর্নামেন্ট বন্ধ করার কোন পথ ছিল না। তা সে যতই সাম্প্রদায়িক হোক না কেন, সে যতই গান্ধীজীর বারণ থাক না কেন – অর্থের কাছে মহাত্মাকেও হার মানতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন :
ডোনাল্ড ট্রাম্প ফুটবলও খেলতেন, কিনতে চেয়েছিলেন একটা ক্লাবও
ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রতি কঠোর হলো বিসিসিআই, মানতে হবে দশটি নির্দেশ
আইপিএলের (IPL2025 Business)দুটো জিনিস খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখার আছে। এক, এতে আপনি কোনভাবেই সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন না জেনেও এর পেছনে মাথা খাটাচ্ছেন। দুই, আপনি এখানে রাজ্যের কথা এমনকি দেশের কথা ভাবছেন না, আপনার ভাবনাটা হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক, নিজের দলের ভালোর জন্য আপনি লোকাল ও গ্লোবালকে একাকার করে দিচ্ছেন। কোন সীমানা মানছেন না। কোন বৈধতার তোয়াক্কা নয়। একনিষ্ঠভাবে শুধুই সফল হতে চাওয়া। জাতীয় দলের বিরুদ্ধে খেললে আপনি সবসময়ই শোয়েব আখতার বা রিকি পন্টিং এর খারাপ চেয়ে এসেছেন। সেই একই ব্যক্তিকে দলে পেয়ে এখন বিপরীতে মনকে চালনা করছেন। মুহূর্তে একটা অদৃশ্য দেওয়াল মাঝখান থেকে সরে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আইপিএলে তারাই আবার বদলে যাবে, হয়তো রিকি পন্টিংদের পা পিছলানোর অপেক্ষায় থাকবে।
কিন্তু আইপিএলের সময়টুকু যে সবাই এক হয়ে কাটালেন, ক’দিন বাদে তার কোন ছাপ ও থাকবে না মনে। হাজার হাজার মানুষ দিনের পর দিন যে বেড়াহীন, শ্রেণীহীন গড়তে চাইল যেটা এবারও হবে।
সবাই আইপিএলের সময় বন্ধু বাকি সময় শত্রু। একটু ভেবে দেখবেন, সেটাও কিন্তু কম নয়। ভবিষ্যৎ আইপিএলের জন্য যদি সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় সেটাও হবে বড় পাওনা।
যে বাজারকে আপনি উঠতে বসতে গালাগালি দিচ্ছেন, সেই বাজার- অর্থ -বানিজ্যই আপনাকে আন্তর্জাতিক হতে সাহায্য করছে। আপনাকে প্রকৃত হতে সাহায্য করছে। এটাই বা কম কিসের।