Sonagachi Urban Reality
ক্লাউড টিভি ডেস্ক : “খাটে না চটে?” এই প্রশ্নেই শুরু হয় দরদাম। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিসার—সবারই গন্তব্য হতে পারে এই অলিগলি। এখানে ‘খদ্দের’ যেমন, ‘রেট’ তেমন। ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার পর্যন্ত চলে দরদাম। কারও কাছে পেটের খিদে, কারও কাছে চাহিদার সস্তা পরিণতি।কলকাতার বুকে এমন একটি জায়গা, যার নাম উচ্চারণ করতেও আজও অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত। সোনাগাছি—শুধু একটি স্থান নয়, বাংলার যৌন রাজনীতির, ইতিহাসের, এবং প্রান্তিক নারীদের সাহসিকতার নাম। রাস্তায় দাঁড়ানো একরত্তি ঘর, ছেঁড়া চাদর, গুমোট বাতাস আর পুরুষের হঠাৎ আসা-যাওয়ার গল্পে তৈরি এই জায়গার পেছনে রয়েছে বহু বছর ধরে চলা ইতিহাস, বাস্তবতা আর অজানা অনেক কিছু।
উনিশ শতকে কলকাতায় ব্রিটিশদের আগমন আর সাথে তাদের ফুর্তির বন্দোবস্ত তৈরি করতে গিয়েই গড়ে ওঠে সোনাগাছির গোড়াপত্তন। ইংল্যান্ড থেকে আসা তরুণ সাহেবদের বিবি-বাচ্চা ছিল দূরে, ফুর্তির জন্য তারা টানতে শুরু করল স্থানীয় বিধবা নারী ও গরিব মেয়েদের। কেউ কেউ বলেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও অন্য জমিদার বাবুরাই প্রথমে এই ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তখন এটি ছিল কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট আর চিতপুরের মাঝামাঝি এক অঞ্চল। পরে, সানাউল্লাহ বা সোনা গাজি নামে পরিচিত এক মুসলমান সাধুবাবার নামেই জায়গার নাম হয় ‘সোনাগাছি’।
সোনাগাছির বাস্তবতা কোনও গল্প নয়। এখানে প্রায় ১০,০০০ যৌনকর্মী কাজ করেন, যাদের মধ্যে ৬,০০০ জন স্থায়ীভাবে এখানে থাকেন, বাকি ৪,০০০ জন প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা-যাওয়া করেন। জীবনের রঙ এখানে ধূসর। একটি ছোট ঘরে একটা খাট, এক বালতি জল, এক বোতল—এতেই চলে জীবনযুদ্ধ। অধিকাংশ ঘরেই নেই জানালা, নেই আলো-বাতাস। ছেঁড়া চাদরে ঘুম, গন্ধে গুমোট পরিবেশ—এই ভাবেই চলতে থাকে যাপিত জীবন।
এখানকার প্রায় সব নারীরাই নিজের আসল নাম গোপন করে নতুন নামে পরিচিত হন—দুই বা তিন অক্ষরের সহজ নাম। বেশিরভাগ যৌনকর্মী আজ আর বাঙালি নন। বিহার, বাংলাদেশ, নেপাল থেকে মেয়েরা এসে এখানে যোগ দেন। কিছুজন আসেন স্বেচ্ছায়, অনেকে ঠকেই, আবার কেউ আসে পারিবারিক পেশার সূত্র ধরে।
আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভেঙে যেতে পারে সব তাপমাত্রা রেকর্ড: ডব্লিউএমওর সতর্কবার্তা
১৯৯২ সালে শুরু হয় সোনাগাছি প্রজেক্ট—ডাঃ স্মরজিৎ জানার উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল কন্ডোম ব্যবহারে জোর দেওয়া, এইচআইভি সংক্রমণ রোখা ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি। যৌনকর্মীদের মধ্যেই গড়ে তোলা হয় একটি শক্তিশালী সমবায়—দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি (DMSC)। এই সংস্থাই আজ কাজ করছে রাজ্যের প্রায় ৬৫,০০০ যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের নিয়ে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ঋণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা—সবই এর আওতায়। এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫%-এর নিচে নামিয়ে আনায় রাষ্ট্রসংঘ একে ‘বেস্ট প্র্যাকটিস মডেল’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
২০০৫ সালে সোনাগাছির শিশুদের নিয়ে তৈরি Born Into Brothels অস্কার জেতে। এই তথ্যচিত্রে ফুটে ওঠে যৌনকর্মীদের সন্তানদের আশা-নিরাশা আর সামাজিক উপেক্ষা। এছাড়া সোনাগাছিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বহু যাত্রাপালা, সিনেমা ও নাটক—১৮৮০ সালে লেখা বেশ্যালীলা ছিল প্রথম।
আজকের সোনাগাছি শুধুই যৌনতার পল্লী নয়—এটা প্রতিবাদের জায়গা। এখানে যৌনকর্মীরা নিজেরা দুর্গাপুজো করেন, সমাজকে জানান, তাঁরা ধর্মবিহীন নন, তাঁরা বাঁচতে চান সম্মানের সঙ্গে। ‘Sex Work is Real Work’ এই স্লোগানে ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের প্রথম যৌনকর্মী সম্মেলন, যার আয়োজক ছিল দুর্বার।
যৌনকর্মীর জীবন সহজ নয়। কিন্তু তাঁদের অনেকেই আজ এই পেশাকে বেছে নিচ্ছেন স্বাধীনতা ও সম্মানের খোঁজে। সমাজ যাদের ঘৃণায় দূরে সরিয়ে রাখে, তারাই আবার সমাজের কোনও না কোনও অংশের অন্ধকার চাহিদা মেটায়। তাই সাহস করে বলা যায়, সোনাগাছি শুধুই এক নিষিদ্ধ পল্লী নয়, এটা নারীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক নীরব যুদ্ধক্ষেত্র।
আরও পড়ুন :
অরিন্দম শীলের নতুন ছবি ‘কর্পূর’: বাম আমলের শিক্ষা দুর্নীতি আর মনীষা অন্তর্ধান এবার রূপালি পর্দায়